উপেন্দ্র বললো "কি রে , হিন্দু মিল কি তোর না হলেই নয় ?" তা এই মাঝরাতে এই কূট প্রশ্নের জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একি ভনিতা! প্রথম বার বিদেশ যাচ্ছি তাও আবার এই কনকনে ঠান্ডার মাঝে মার্কিন দেশের শিকাগোয়, কোথায় তাই নিয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, আর বলে কিনা হিন্দু মিল। সত্যি বলতে কি হিন্দু মিল বস্তু টা যে কি ভালো করে তাও জানি না। শুনেছি অফিস থেকে টিকিট করার সময় হিন্দু মিল বলে দেয় আর বঙ্গসন্তান, বিদেশে কি খাওয়া পাওয়া যাবে সেটার চিন্তায় হিন্দু বললে অন্তত ধৰ্ম নিয়ে টানাটানি পড়বে না সেটাই বাঁচোয়া!
তা যা বলছিলাম, উপেন্দ্র যেটা ববুঝিয়ে বলল, আমরা অনেক আগে এসেছি চেকইন করতে আর ইকোনমি ক্লাস ওভারবুক হয়ে আছে তাই ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স আমাদের বলেছে খাওয়া নিয়ে খুনখুঁতুনি না থাকলে নাকি আমাদের আপগ্রেড করে দেবে। আপগ্রেড করলে কি হয়, কিভাবে করে সেসব নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন না করে এটুকু শুধু কন্ফার্ম করা গেলো যে গরিব ভারতীয় দের কিছু এক্সট্রা দিতে হবে না ।
যাইহোক তারপর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা - কি হয় কি হয় ভাব আর কি !!
তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ দুরু দুরু বক্ষে তো প্লেন এ উঠতে গেলাম - কিন্ত প্রথমেই চমক! প্লেন এর গেট দিয়ে উঠে ভালোমানুষের মতো ইকোনমি র দিকে চলে যাওয়াই তো আমাদের অভ্যেস আর তাই করতে যাচ্ছিলাম আনমনে, কিন্ত সুন্দরী এয়ারহোস্টেস একটু নিমকি হাসি দিয়ে বললেন ওপরে যান । সেকি রে বাবা? ওপরে যাবো কিরকম? প্লেন তো এখনো মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে? নাকি একেবারেই স্বর্গে যাবার কথা বলছে ? কি এমন দশ করলাম যে অকালে স্বর্গে যেতে হবে? এইসব সাত পাঁচ ভাবছি আর আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে ব্যাপারটা উনি খোলসা করলেন, ওপর মানে স্বর্গে নয়, প্লেন এর দোতলায় হলো ফার্স্ট ক্লাস আর বিসনেস ক্লাস আর উনি সেখানেই আমাদের যেতে বলছেন!! কি করে আর বুঝবো। ..আদার বেপারী।
সত্যি তো আগে দেখি নি .... হরি বলো, দেখি প্লেন এর পেছন দিয়ে দিব্বি স্বর্গে যাবার থুড়ি দোতলায় যাবার সিঁড়ি । চলে যাওয়া গেলো দোতলায় । সেখানে যেতে আরেকজন এয়ার হোস্টেস বললেন জ্যাকেট টা দিয়ে দিন । তা দিলাম - সেটা চলে গেলো একটা স্পেশাল ক্লোজেট এ। তারপর সিট এ এসে বসলাম - তবে সেটা সিট বলা চলে না, আমার কাছে রাজ্ সিংহাসন ই বটে । পুরো ১৮০ ডিগ্রী ফ্ল্যাট হয়ে যাওয়া সিট যেটা বিছানা হয়ে যায় , স্পেশাল আ লা কার্ট মেনু, ওয়াইন এর মেনু, কি নেই! তারপর বসলাম আর ভাবছি কখন লজেন্স নিয়ে আসবে আর মনের সুখে লজেন্স নেবো (যারা পুরোনো দিনের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স চড়েছেন তারা জানেন প্লেন এর সিট এ বসার পর ট্রে তে করে লজেন্স নিয়ে আসতো আর একটার বেশি নিতে গেলেই ধমক দিতো !!) - কিন্তু কি কপাল , ফার্স্ট ক্লাস এর কি ছিরি কিছুই তো দিলো না !! কিন্তু একটু পরেই সেই চমৎকার, প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া ঘোষণা । সামনে টেবিল এর ওপর একটা ট্রে ভর্তি কতরকম এর চকোলেট , লজেন্স, ক্যান্ডি যে রাখা আছে তার কোনো ঠিক নেই - যত খুশি নিয়ে নাও । দুবার বলতে হলো না , চটপট হাত আর মুখের কাজ করে নিলাম। কিছু টা পেটে আর কিছু টা ব্যাগ এ চালানকরা গেলো !
যাইহোক এতো কাণ্ডের পরে প্লেন তো চলতে শুরু করলো আর দোতলা বাসি বলে কিছু আলাদা বেপার টের পেলাম না যেরকম টেক অফ এর সময় পেটের মধ্যে টা একটু ফাঁকা লাগে সেরকম ই লাগলো আরকি !!
তারপর খানিক টা যাবার পরে উশখুশ করছি কখন ভালো মান্দা খাবার আসবে আর না জানি কি সাংঘাতিক খাবার খাওয়াবে । কিন্তু খানিক পরে এয়ার হোস্টেস দেখি খাবার এর বদলে কি একটা কাগজ দিয়ে গেলো। আর সেটা যে কি ভালো করে দেখে খোলসা হল, এটি একটি খাবার এর মেনু কার্ড। তা মাঝ আকাশে মেনু কার্ড কি রকম? রান্না করে এনে দেবে নাকি? তারপর বোঝা গেলো অতটা না হলেও অনেকটা সেরকম ই - ফার্স্ট ক্লাস এ আসলে অনেকটা রেস্তুরাঁ তে যাকে বলে বলে আ লা কার্ট মেনু - মেনু তে থাকা যা কিছু অর্ডার করা যেতে পারে।
সেটা তো বোঝা গেলো কিন্তু সমস্যায় পড়া গেলো ওয়াইন এর মেনু নিয়ে, সেকি সব বিচিত্র আর খটোমটো নাম আর সব পিলে চমকানো বর্ণনা । পাগলা খাবি কি ঝাঁজে মরে যাবি গোছের ব্যাপার আর কি !!!
কিন্তু সেখানে সহায় হলো উপেন্দ্র - বললো নাম দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু খাবই যখন শ্যাম্পেইন খাবো , সেটাই সাধারণত দামি হয়। যুক্তি তা ফেলে দেবার মতো নয়। তাই অর্ডার করা গেলো আর এলো বেশ বাহারি গ্লাস। বেশ একটা রাজা গজা ভাব আর কি। কিন্তু সত্যি বলতে কি খেয়ে খুব একটা সুখ হলো না - কুকুর এর পেটে ঘি কি আর সহ্য হয় ...
যাইহোক পানীয় তে খুব একটা সুবিধে না দেখে আমরা খাবার এর দিকে গেলাম। মেনু দেখে টেখে ল্যাম্ব এর কিছু একটা অর্ডার করেছিলাম মনে পড়ে এখন। ছিল অনেক কিছু কিন্তু চিকেন সবসময় খাই বলে নিলাম না আর বীফ তো নৈব নৈব চ !! খাবার পরে প্লেট টেট নিয়ে গেলো । তারপর ঘুম এর চেষ্টা । আর সত্যি কথা বলতে সেকি কি আরামের ঘুম আজ অবধি প্লেন এ ঘুমাই নি !! পুরো বাড়ির বিছানা মতো টান টান হয়ে শুয়ে (একটা পুজো সংখ্যা হলে ষোলো কলা পূর্ণ হতো) নিটোল একটা ঘুম। উঠলাম যখন নামার সময় হয়ে এসেছে প্রায় । কিন্তু খাওয়া আরও কিছু বাকি ছিল বটে। এবার কতরকম স্নাক্স আবার সেই ওয়াইন সঙ্গে কতরকম জুস কি আর বলবো। কিন্তু সেই আরাম বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। প্লেন নামতে শুরু করলো আর রাজকীয় আরাম এর ও শেষ হলো। কিন্তু এটা যে কত বড়ো ক্ষতি করলো তা বলার না। ইংরেজি তে যাকে বলে setting the bar so high !!
হিথরো তে নেমে আমাদের আবার প্লেন বদলাতে হবে। আর কলকাতা থেকেই বলে দিয়েছিলো যে হিথরো থেকে শিকাগো ফ্লাইট আমরা মিস করবো কারণ কলকাতা হিথরো ফ্লাইট দেরিতে ছেড়েছিলো। তাই ওখান থেকেই আমাদের আমেরিকান এয়ারলাইন্স এর ফ্লাইট এ চেঞ্জ করে দিয়েছিলো। তাই হিথরো তে নেমে জ্যাকেট হারিয়ে , নতুন এয়ারলাইন্স এ গেট খুঁজতে গিয়ে এনাউন্সমেন্ট শুনে সেই দৌড় কোনোদিন ই ভুলবো না।
তবে সবচেয়ে হতাশ হয়েছিলাম সব কিছু পেরিয়ে মার্কিনি এয়ারলাইন্স এ ইকোনমি ক্লাস এর সিট এ বসে প্রথম বার আমেরিকান খাবার পেয়ে - প্লেন এ লোক জন এরকম ঠাসাঠাসি করে বসে? এই রকম শক্ত পাঁউরুটি আর ঠান্ডা চিকেন খায় ? এই রকম খাড়া হয়ে বসে বসে আট দশ ঘন্টা যেতে পারে মানুষ ? নিশ্চই পারে আর আমিও পারলাম !! পূর্ণ মূষিক ভব:!!
সেই থেকে আজ পর্যন্ত অনেক বার অনেক আগে গেছি, শেষ মুহূর্তে গেছি, অনেক প্রার্থনা করে গেছি, বলেছি ঠাকুর আর একটা ইকোনমি ওভারবুকিং পাইয়ে দাও, কিন্তু ভবি ভোলে নি। কি জানি হয়তো আমি ঠিক ঠাকুর কে ধরতে পারিনি? আচ্ছা এই এয়ারলাইন্স এর বুকিং আর সিটিং তা কে দেখেন জানেন? জানতে পারলে একটু জানাবেন ? আমার আমার ডিসেম্বর নাগাদ একটু লং জার্নি আছে কিনা, দেখতাম আর একবার চেষ্টা করে !!!
x